রুদ্রচণ্ডীমঠের ভৈরব
এক অন্য জগতের হাতছানি
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
জীবনের কিছু কিছু সময় আসে যখন মানুষ হঠাৎ করে আবিষ্কার করে যে জীবন কত অনিত্য ও নশ্বর। আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগে আমার জীবনে ঘনিয়ে এসেছিল এমন এক অভিজ্ঞতার কাল। ছুটন্ত তরুণ জীবনে হঠাৎ নামল অসুস্থতার অন্ধকার। ডাক্তার দাদার হাতযশ আর পরম করুণাময়ের কৃপায় প্রাণরক্ষা হল। কিন্তু জীবনের উপলব্ধি গেল বদলে । বুঝলাম জীবনের অমোঘ নশ্বরতা। পাঠক হিসেবে আমি আগ্রাসী টাইপ ছোটবেলা থেকেই। যা পাই হাতের সামনে পড়ে ফেলি গোগ্রাসে। বাংলা সাহিত্যের অতিলৌকিক অলৌকিক দিকটার প্রতি আকর্ষণ ছোটবেলা থেকেই। পরবর্তীতে বিভূতিভূষণের, শরদিন্দুর নিবিড় পাঠে সেই ইচ্ছা যেন পূর্ণতা পেল। অপারেশন করে বর্ধমান ফেরার পর বাকি জীবনটা যখন বোনাস হিসেবে পেলাম । তখন দেখলাম মন টানছে অন্যতর এক লোকের ইশারায় ।
আলোছায়ার সে জগতে ঢোকার চেষ্টা করলাম অজস্র বইয়ের হাত ধরে। কিছু অদ্ভুত মানুষের সান্নিধ্যে আসি এ সময়। নতুন করে পড়তে শুরু করি কালিকানন্দ অবধূতের উদ্ধারণপুরের ঘাট। মানুষের জীবনের চরম পরিণতি যে কালো কয়লা ও সাদা হাড় তা সজনীকান্ত দাস মনে করিয়ে দিয়েছেন এ বইয়ের ভূমিকায়। তারাপ্রণব ব্রক্ষ্মচারীর অনেকগুলো বইও এই পর্বেই পড়ি।
অবধূতের আসল নাম দুলাল মুখোপাধ্যায়। দিব্য ছিলেন সরকারি চাকরিতে। কিন্তু এক অদৃশ্য রহস্যময় লোক এঁকে টানতে লাগল। ঘর ছাড়লেন সেই টানে। চললেন সুদূর পাকিস্তানের হিংলাজ তীর্থ দর্শনে। ১৩৬৩ বঙ্গাব্দের পৌষে প্রকাশিত হল প্রখ্যাত উপন্যাস উদ্ধারণপুরের ঘাট। লেখাটি প্রথমে বেরোয় ধারাবাহিকভাবে কথাসাহিত্য পত্রিকায়। অবধূত ছিলেন সত্যকার তান্ত্রিক সন্ন্যাসী। কাটোয়ার প্রখ্যাত শ্মশান উদ্ধারণপুরের ঘাটে কাটান বেশ কিছুদিন। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা এ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে শ্মশানের মহাকাব্য রূপে অভিহিত। কিন্তু আজকের লেখা এ উপন্যাস নিয়ে নয়। পূর্ব বর্ধমানের নাড়ুগ্রামের আদি বাসিন্দা সুসাহিত্যিক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় কৈশোর যৌবনে ছিলেন অবধূতের অত্যন্ত কাছের লোক।
অবধূতের চুঁচুড়ার বাড়ি রুদ্রচণ্ডীমঠে ছিল ষষ্ঠীবাবুর নিত্য যাতায়াত। সে অভিজ্ঞতা নিয়ে ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় লেখেন অবধূতের জীবনকথা রুদ্রচণ্ডীমঠের ভৈরব। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। দীপ প্রকাশন থেকে তৃতীয় মুদ্রণ হয়েছে গত জানুয়ারিতে। অবধূতের জীবনী তেমন সুলভ নয়। ষষ্ঠীপদ বাবুর বইটি সেই অভাব অনেকটাই মিটিয়েছে। খ্যাতনামা সাহিত্যিকের হাতে এ জীবনকথা হয়ে উঠেছে স্বাদু উপন্যাসের সামিল। তান্ত্রিক সাধক তাঁর জীবনের গূঢ় সাধনার তত্ত্ব উজাড় করে দিয়েছেন লেখকের কাছে। গা ছমছমে পরিবেশে সাধকের লতা সাধনার বিবরণ সহ নানা অলৌকিক ঘটনার সমাবেশ ও আধ্যাত্মিক প্রসঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে বইখানি ।
অবধূত সাধন জীবনের পাশাপাশি গার্হস্থ্য জীবনেও ছিলেন দীর্ঘদিন। সেখানে তিনি আর পাঁচটা গড় বাঙালির মতোই রসগোল্লা ও নানাপ্রকার মাছের ভক্ত। তান্ত্রিক সাধনার ইঙ্গিত ছিল ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের জীবনেও। খ্যাতকীর্তি সাধক অবধূতের দৃষ্টি এড়ায় নি সেটা। তিনি একদিকে হয়েছেন ষষ্ঠীবাবুর কর্মজীবনের প্রবেশপথের কারিগর। অন্যদিকে বারবার তাঁকে ঠেলেছেন সাহিত্য ও আধ্যাত্মিক সাধনার পথে। সত্যজিৎ রায় থেকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ষষ্ঠীপদ বাবু এসব মহীরূহের সান্নিধ্যে এসেছেন অবধূতের হাত ধরেই। তাঁর নিজের জীবনেও ঘটে গেছে নানা চমকপ্রদ অলৌকিক ঘটনা।
বস্তুত অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত প্রসঙ্গ বিধৃত হয়েছে এ বইয়ের পরতে পরতে। বইটির দুটি অংশ। প্রথমাংশে রয়েছে অবধূত জীবনী। দ্বিতীয় অংশে রয়েছে বেশ কিছু সাধক মহাপুরুষের কথা যাঁদের প্রত্যক্ষ করেছেন ষষ্ঠীপদ বাবু। ষষ্ঠী বাবু মূলত পরিচিত কিশোর সাহিত্যের জন্য। পাণ্ডব গোয়েন্দা আজও অনেক কিশোরের হাতে হাতে ফেরে। কিন্তু লেখক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় ও তান্ত্রিক সাহিত্যিক অবধূতকে বুঝতে হলে হাতে নিতেই হবে রুদ্রচণ্ডীমঠের ভৈরব বইখানি। এ বইতে একদিকে যেমন মিলবে স্নিগ্ধ আধ্যাত্মিকতার সৌরভ।
অন্যদিকে তেমনই পাওয়া যাবে তন্ত্র জগতের গায়ে কাঁটা দেওয়া এমন সব অভিজ্ঞতার বিবরণ, যা গৃহী ও সংসারী লোকের জীবনে সহজলভ্য নয়। এ বই শুধু অবধূতের জীবনকাহিনীর গণ্ডী ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে আধ্যাত্মিকতা প্রেমী পাঠকের এক অপরূপ রসাস্বাদনের পাঠ্যবস্তু। এ বইতে আছে এমন অনেক নিগূঢ় তত্ত্বের সন্ধান যা সাহিত্যের মাত্রা ছাড়িয়ে পাঠককে পৌঁছে দেবে এক অন্য দ্যুতিমান লোকে। যে লোক আমাদের প্রচলিত যুক্তি বুদ্ধির অনেক বাইরে। সেই লোকে বাস করেন এমন সাধক যিনি জীবনের পার্থিব জটিলতার অনেক ঊর্ধ্বে। জীবনের প্রাপ্তব্য চতুর্বর্গ ধর্ম -অর্থ-কাম-মোক্ষ কিভাবে সাধকের জীবনকে প্রভাবিত করে তার বিবরণ তো মিলবেই সঙ্গে মিলবে আরও অনেক গোপন তন্ত্রকথা।
সে এক অপূর্ব অনৈসর্গিক দেশ। যেখানে সিদ্ধ কৌল তান্ত্রিকের সাধনপথে মৃত্যুর পরপার থেকে আবির্ভাব হয় যুবতীর অতৃপ্ত আত্মার। তার কামবাসনার পরিতৃপ্তির অন্তে সাধক তাকে মুক্ত করে দেন ব্রক্ষ্মাণ্ডের অসীম চরাচরের উন্মুক্ত অঙ্গনে । সেই সীমাহীন বিরাটের কোলে যেন আকাশ ধূমাচ্ছন্ন হয় তান্ত্রিক সাধক সাহিত্যিক অবধূতের ধুনির আগুনের লেলিহান শিখায়ব । প্রয়াত ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের কলমে এ বই বাঙালি পাঠকের এক পরম প্রাপ্তি।
দীপ প্রকাশন
৩০০ টাকা
Tags
Indian