বইয়ের নাম: স্বজনসকাশে
✍🏾 নবনীতা দেবসেন
স্বজনসকাশে নিয়ে লেখিকার প্রসঙ্গ-কথা
একদিন এই উৎসাহী তরুণ প্রকাশকের মনে হল আমাকে দিয়ে অবিলম্বেই আত্মজীবনী লেখানো দরকার, যেহেতু আমার সৌভাগ্য হয়েছে অনেক প্রণম্য মানুষের সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের। তাঁদের কথা, তাঁদের স্মৃতি। কিন্তু যেহেতু আমি অলস, সেই দুরূহ কাজ এড়িয়ে যেতে, আমি বললুম, “আরে, কত তো টুকরো টুকরো লেখা রয়েছে আমার প্রিয় মানুষদের নিয়ে। অনেক দিন ধরে তো এটা সেটা লিখছি এখানে সেখানে, সেসব গুছিয়ে নিলেই একটা স্মৃতিমেদুর বই হয়ে যাবে তো?” আমি কিছু বই দিতে পারব, আর কিছু তাঁকে সংগ্রহ করে নিতে হবে। তো, তিনি অনতিবিলম্বেই একটি পাণ্ডুলিপি বানিয়ে এনেছেন, কিছু নিজের চেষ্টায় কিছু আমার স্নেহভাজন, ছাত্রোপম শ্রীমান অর্ণব দত্ত ও শ্রীমান কানাই বারুই-এর সহায়তায়।
আরো কতো প্রিয়জনের কথা যে এদিকে সেদিকে রয়ে গিয়েছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এই মকরসংক্রান্তিতে আমার সাতাত্তর বছর বয়েস হবে। কম তো মানুষের কাছাকাছি আসিনি? দেশে বিদেশে প্রচুর আশ্চর্য দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। অনেক স্নেহ পেয়েছি এ জীবনে । এযাত্রায় সবার গল্প একত্রে সাজানো গেল না। পরের বারের জন্য তোলা রইল। স্বজনসকাশে তো যত বেশি আসা যায় ততই আনন্দ !
সবচেয়ে আহ্লাদের কথা, এত শরীর খারাপ সত্ত্বেও, আমাদের পূজনীয় নীরেনদা স্নেহভরে এই বইয়ের ভূমিকা লিখে দিতে রাজি হয়েছেন। আমার প্রাণভরা প্রণাম রইলো। ‘স্বজনসকাশে’ এই নামের যাথার্থ্য প্রমাণিত হল ভূমিকাতেই।
স্বজনসকাশে রিভিউঃ
সে কি ভালো আছে? যতটা থাকলে ভালো অন্ধকারে একা একা থাকা যায় ততটা ভালো কি? এ গল্প বরং থাক। চলে যাই নবনীতার কাছে,তার স্বজনদের মাঝে। নরেন্দ্র দেব-রাধারানীর ঔরসজাত তনয়া ,স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যার নাম রেখেছেন (রাধারানীর পুনর্বিবাহের প্রাক্কালে কবিগুরু এই নামখানি তাকে দিয়েছিলেন, রানীদেবী পিতৃপ্রদত্ত নামের প্রতি অকুণ্ঠ টান আর ভালোবাসার জন্য বিনয়ের সাথে রাজি হবার অপারগতা জানালেও পরবর্তীতে নিজের একমাত্র কন্যার মাধ্যমে সন্মান জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের নামকরণের)।
নবনীতার দাবি বিস্মৃতির বিচারে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হবেন সহজেই কারন তার স্মৃতি বড্ড দুর্বল,দেখতে তিনি ছোটখাটো বেঁটে বদখত ভেতো বাঙালী (নির্জলা মিথ্যাচার ছাড়া আর কিচ্ছু না, আদতে অসম্ভব রূপবতী পূর্ন চন্দ্রের মতো ভরাট মুখ, উজ্জ্বল হাসি, প্রানশক্তিতে ভরপুর সরস রসিকতার এক পুর্ন আকরখনি নবনীতা) পাতায় পাতায় স্বজন বন্ধুদের নিয়ে এমন প্রাঞ্জল মোহন ভাষায় লিখেছেন, গহনের গহীনে গেঁথে যায় স্মৃতি কথাগুলো।
স্মৃতির মেদুর রোদে সিক্ত হয়েছি প্রতি পাতা পড়ে। সুধর্মা-তপোধাম-ইলাবাস-ভালোবাসা সাহিত্য কিংবা ইতিহাসের উজ্জ্বল সাক্ষী বাড়িগুলোর গল্প সমৃদ্ধ করেছে পাঠকের অজানাকে।কবিতা ভবনের গল্প, প্রতিভা বসুর দশভূজা রুপে দেখার সৌভাগ্য, বুদ্ধদেবের বুদ্ধি চিন্তা গবেষনার সাথে ওতপ্রোতভাবে ভাবে চাক্ষুষ করার কথা কজনে জানতুম আমরা? অশোক মিত্র বা নরেশ গুহর মধ্যে যেকোনো একজনকে জামাতা রূপে গ্রহণ করার গোপন মনবাসনার জোর গুঞ্জন কলকাতার আকাশে বাতাসে যখন ভেসে বেড়াত, নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে মীনাক্ষী-জ্যোতির্ময়ের জোড় বাধা ,অলকনন্দা প্যাটেলের বিয়ের পিঁড়ি আঁকা, সেই পিঁড়ি বেনারসে বয়ে নিয়ে যাওয়া আশোক-গৌরির ঘরের খবর কজন জানাতো আমাদের?
সুনীতি-সুকুমারী-সত্যজিৎ-সুনীল-শক্তি-শ্যামল-শঙ্খ-তপন-মল্লিকা প্রত্যেকের সাথে এত অন্তরঙ্গ আড্ডা গান কবিতার স্মৃতি, ভালোবাসা বাড়ির ভালো-বাসার বারান্দা হয়ে উঠার নেপথ্য কারিগর সৌরনীল থেকে ঋতুপর্ণ ঘোষের রূপান্তরের চিত্র হয়তো আমি জানতুম ই না এমন করে কক্ষোনা।
অমর্ত্য কে নিয়ে তো চিরকালের মতো মিষ্টি পরিমিত বোধের পরিচয় দিয়েছেন লেখার খাতায়। প্রাক্তন মানেই বিষাক্ত গরল ঢেলে বিষবাস্পে বাঁচতে হবে এমন রীতির বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছেন বেশ কয়েকটি জায়গায়। ভেঙ্গে যাওয়া সংসারের কাটাকুটির খেলায় ক্ষতখানির ভাগীদার নিজেকে যতটা মেনেছেন, অমর্ত্যর জন্য ততটাই মৌন থেকেছেন। সংসারসুধার অমৃত রসের কতটা বশে আর কতটা বিবশে ছিলেন আমৃত্যু থেকেছেন নিরপেক্ষ নীরব। অমর্ত্য বরং প্রশংসিত হয়েছেন বেশি নবনীতার কলমে, জনসম্মুখে। অথচ যার ঘর পুড়েছে,মন ভেঙেছে,সন্তানেরা স্বাভাবিক সম্পর্কের সংসার থেকে বঞ্চিত হয়েছে , সেই নবনীতা'রই ছিল অনুযোগের সবচেয়ে বড় অধিকার।
নবনীতার শক্তি শব্দ শিক্ষা সহবত মানুষকে সমৃদ্ধ করার দুর্লভ স্বভাব, এত আশ্চর্য সব সদগুন একসাথে থাকা সত্ত্বেও চিরকাল নিজেকে অহংকারের আশনাইতে বাঁধেননি ব্যক্তিজীবনে বা পোশাকি পরিবেশে।
নরেন্দ্র দেব হয়তো জন্মলগ্ন থেকে নিজের "সবাইরে বাসো ভালো ,ভুলে থাকো ভুলগুলো, বেঁচে থাকো নিজের আলোয়"মন্ত্রে দীক্ষিত করে দিয়ে গেছেন কন্যাকে।
এ জীবনে হয়তো এত ভালো আমি কখনোই হতে পারবো না, ক্ষুদ্র জীবনে স্বল্প সময়ে ভালোবেসে বাঁধার বদলে বন্ধনের গ্ৰন্থিগুলো ক্ষয়াটে চাঁদের মতো ম্রিয়মাণ হয়ে হারিয়ে দিয়ে যায় বারবার মনের জোর, বিশ্বাসের ধার,আশা রাখার স্বপ্ন দেখার সাধ।আছে রাগ ক্ষোভ জেদ হিংসের মতো সর্বনাশা কতগুলো নিজস্ব সীমাবদ্ধতা।জোন বায়াজ তো আর নই যে; we shall overcome গানের মতো সত্যি সত্যিই ওভারকাম করে ফেলবো ইন্দ্রিয়ের ইতরবিশেষ বদগুন গুলো।
তাই পরম করুণাময়ের কাছে একান্ত প্রার্থনা লীলা মজুমদারের মতো এক্কেবারে সবকিছু সব্বাই কে ভুলিয়ে দিয়ে অ্যালজাইমারে যেন আমি হারিয়ে যাই। নয়তো প্রণবেন্দুর মতো ভালোবাসাহীন অবিশ্বাসের আতংকে বেঁচে থাকার ভয় ক্রমশ গিলে খাবে আমায়।
তার পরে শুধু যখন, পুরোটা দেহ আগুনের আঙুলে গলে যাবে, তখন সবাই বলবে: আহা পুড়েছিল। সারাজীবন পুড়েছিল। অন্যের এমন আফসোসের দান করুনা পাত্রী বিধাতা তুমি কক্ষনো যেন করোনা আমায়।
রেটিং:৫/৫
Tags
Indian