বই : খেলাঘর
লেখক : রনিন
প্রকাশনা: কল্পবিশ্ব
বিষয় : গেমিং ফ্যান্টাসি
মূল্য : ৪৯৯
মূল্যায়ন : ১০/১০
খেলাঘর উপন্যাস নিয়ে লেখক রনিন এর অভিমত
আমার লুকোবার জন্য একটা ঘর আছে। বই ভরতি আলমারি, চেয়ার-টেবিল, রংচটা ল্যাপটপ আর অনেকগুলো কালো রঙের তার। ওগুলো আসলে ঘরটার মুখোশ। সাধারণ সাজার সফল প্রয়াস। কিন্তু আমি জানি, দরজার ওধারে একটা আস্ত মায়া-অরণ্য লুকিয়ে আছে সবার অজান্তে। সেখানে ঢোকার চাবিকাঠি শুধু আমার হাতে। আমার ডাকেই একমাত্র ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে ওই অরণ্যের প্রবেশপথ। ওই ঘরখানা তাই আমার শৈশবের গল্পে মোড়া চিলেকোঠা। অথবা গাছের ডালে ঝুলতে থাকা গুপ্ত ‘ট্রি-হাউস' ।
তা এরকমই এক বৃষ্টি-ভেজা দুপুরে ঢুকে পড়েছিলাম সেখানে। কতশত আশ্চর্য জিনিস যে খুঁজে পেলুম, তার ইয়ত্তা নেই। একখানা ডানা পেলুম। মাটিতে ধুলো মেখে গড়াগড়ি খাচ্ছিল সে। যেন কোনও ফড়িংকে নিজের হাতে ছিঁড়েখুঁড়ে তার ডানা মুচড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে কোনও রাগি শিশু। হাতে নিলাম তাকে। আঙুল বুলিয়ে অনুভব করলাম। স্বপ্ন। আনন্দ। সবশেষে যন্ত্রণা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরেকটু এগিয়ে যেতে একখানা তিরের ফলা পেলুম। মাটির বুকে মুখ গুঁজে লুকিয়ে আছে সে। ব্যর্থতা। কয়েক পা চলতেই কিছু দূরে দেখলাম, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একখানা ভগ্নস্তূপের অবয়ব। সবুজ লতা আর শ্যাওলার আস্তরণে ঢাকা পড়েছে তার শ্বেতপাথরের জলুস। কালো সর্বগ্রাসী ফাটলগুলো রাক্ষসের হাঁয়ের মতন জেগে আছে তার শরীরে। স্মৃতির সমাধি। সযত্নে তাকে এড়িয়ে জঙ্গলের পথে যেই না পা দিয়েছি, অমনি খুঁজে পেলুম তাকে।
পাথরের স্তূপে মুখ লুকিয়ে জেগে আছে একখানা একলা তরবারি। স্ফটিকের ফলা, মণিমুক্তোয় মোড়া হাতল, লাল রঙের এক টুকরো কাপড় বাঁধা সেখানে। বিষণ্ণ হাওয়ার দোলায় সে ভাসছে। কাছে গিয়ে ধুলো সরিয়ে দেখি, ফলার গায়ে খোদাই-করা শব্দটা—‘ঝঞ্ঝাবিক্ষোভ'। হাতল ধরে টান মারলাম। সে নড়ল না। তবে ওর মধ্যে লুকিয়ে-থাকা সমস্ত অনুভূতি আমার স্নায়ুতে স্নায়ুতে ছড়িয়ে পড়ল ফুলের রেণুর মতন। সংঘাত, পরাক্রম, গৌরব। মনে দোলা লাগল।
জঙ্গল ছেড়ে ত্রস্ত পায়ে ফিরলাম আমার সেই ছন্নছাড়া ঘরটায়। ল্যাপটপের সামনে বসে পড়লাম জ্বোরো রুগির মতন। কিবোর্ড চেপে একটু একটু করে স্মৃতির কবর খুঁড়ে পাতায় পাতায় সাজিয়ে তুললাম সেই জগৎটাকে, যে এখনও আমার স্মৃতিতে বেঁচে আছে বেমালুম। বেঁচে আছে তার সমস্ত গৌরব অক্ষুণ্ণ রেখে। বেঁচে আছে আবার কেউ তাকে নিজের হাতে ছুঁয়ে দেখবে বলে। অপেক্ষা করছে কোনও এক অজানা আগন্তুকের জন্য। সে বেঁচে আছে কোনও একজনের ‘খেলাঘর' হয়ে উঠবে বলেই।
খেলাঘর প্রতিক্রিয়া:
এই বইয়ের মূল্যায়ন করা বেশ কঠিন। কারণ, এর তুলনা কার সাথে করবো? বাংলায় এরকম গেমিং ফ্যান্টাসি আর কখনো লেখা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। লেখক নিজে একজন প্যাশনেট গেমার, সেই সাথে ওনার কলম যথেষ্ট শক্তিশালী। কল্পবিজ্ঞান আর তন্ত্রের সংঘাত চিরন্তন। ইদানিং ফেসবুকেও মাঝে মাঝেই উত্তেজিত আলোচনা চলে এই নিয়ে। এবার আপনি যদি দুটো এক্সট্রিম কল্পনা করেন তাহলে একদিকে আসবে বিভা এবং অন্যদিকে অবশ্যই কল্পবিশ্ব। রনিন এই দুই শিবিরেই সমান তালে লিখে চলেছেন। আর এখানেই ওনার নামকরণের সার্থকতা (রনিন নামের অর্থ হল মুক্ত সামুরাই, যার তরোয়াল কারুর প্রতি দায়বদ্ধ নয়)।
আমি একেবারেই আর্ট বুঝিনা, তবে উজ্জ্বল বাবুর ছিমছাম সরল আঁকা আর আকর্ষণীয় কালার কম্বিনেশন ভালোই লাগে। বইটা হার্ড বাউন্ড হওয়ায় আরো সুন্দর দেখাচ্ছে।
এক কথায় যদি লিখতে হয় গল্পটা কি রকম তাহলে বলতে হয় এটা ওই যাকে বলে “হিরোজ জার্নি”। তবে এটুকু বললে আসলে কিছুই বলা হয়না। বিহান গল্পের শুরুতে নিয়ম গুলো বুঝে নেয়, ঠিক কোনো গেমের শুরুতে যেমন বলা হয় খেলার নিয়ম, কটা লাইফ পাওয়া যাবে, কি করে এনার্জি রিচার্জ হবে, গোল কি, কি কি মড আছে (ওই আপিয়ারেন্স পাল্টানোর জন্য) ইত্যাদি। ম্যাসিভ মাল্টিপ্লেয়ার অনলাইন গেম গুলোর মতন ব্যাপার। অসাধারন বৈচিত্র্যময় ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং সাথে রয়েছে সুন্দর সব কাব্যিক নাম। মেদ বিহীন দ্রুত লয়ের লেখা, অলোকিক ভয়ানক দানবের সাথে শক্তি পরীক্ষার অংশ গুলি চূড়ান্ত আকর্ষণীয় করে তুলেছে। জটিল চরিত্রের আনাগোনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কাহিনীর প্রয়োজনে প্রচুর চরিত্রে আগমন ঘটেছে , বিভিন্ন পর্যায়ে। এদের প্রত্যেকের নাম গুলো বেশ সুন্দর, পূর্ণ জীবনী শক্তি থাকাকালীন এরা রজত শুভ্র। আঘাতের পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রত্যেকের উজ্জ্বলতা কমে যায়। আবারো বোধহয় গেমের ভাষায় ফিরে এসেছি। তবে ইউরেনিয়ার এই জগৎ কে শুধু গেমের ভাষায় ধরে রাখা তা ভুল হবে। বিহানের চোখে দেখা প্রাকৃতিক বর্ণনা পাঠক কে বিস্মিত করতে বাধ্য। এই সকল বর্ননার ছত্রে ছত্রে লেখকের সৌন্দর্য বোধের ছাপ সুস্পষ্ঠ। অদ্ভুত সুন্দর এই জগতের মানুষদের মধ্যেও রয়েছে সাধারণ টানাপোড়েন। হিংসা, লোভ, প্রেম কিছুই বাদ যায়নি এই রূপকথায়।
এতক্ষন পরে যদি আপনার মনে হয় এই লেখা শুধুই ওই বালখিল্য গোলা গুলির লড়াই এ সীমাবদ্ধ তাহলে আপনাকে শেষ অধ্যায়টি পড়ে দেখতে হবে। হঠাৎ ধীর লয়ে জগৎ পরিবর্তন, উত্তেজনা কে গ্রাস করে ফেলে মৃদু বিষণ্ণতা। গানের ভাষায় যাকে বলে তাল ফেরতা। বাস্তবের বিহনের শেষ পরিণতি নিয়ে এর বেশি আর কিছু লিখতে চাইনা, ৩৮৪ পাতার মজাটাই চলে যাবে।
আপনার যদি গেমের পরিভাষার সাথে বিন্দুমাত্র পরিচিতি না থাকে তাহলে একেবারে শেষের টিপ্পনি থেকে পড়া শুরু করুন । শিশুবোধ্য সরল ভাষায় বিশদে সব বোঝানো হয়েছে।
এই বইয়ের এখনো পর্যন্ত তিন প্রকারের সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। একেবারে প্রথমে যে সংস্করণটি প্রকাশ পেয়েছিল তাতে একটি সুন্দর বোর্ড গেম ছিল। সাতটি স্পটিকের ছবিওয়ালা কার্ড দিয়ে মনিমন্থন খেলা শুরু হয়, বাকি নিয়ম বইয়ের শেষে দেওয়া রয়েছে। বাংলা বইয়ের জগতে এরকম বৈচিত্র আর কোথাও চোখে পড়েনি। বর্তমান সংস্করণ এর সাথে এই রঙিন চাকরি গুলো আর দেয়া হয় না তবে উজ্জ্বল বাবুর সুন্দর অলঙ্করণ গুলো পাঠ অভিজ্ঞতা কে আরো মসৃণ করে তুলেছে। আমার কপাল খারাপ, দ্বিতীয় সংস্করণ যারা সংগ্রহ করেছেন তাদের কপালে ওই গেমটি ও জোটেনি, অলঙ্করণ গুলোও নেই। বইটি সম্বন্ধে খারাপ লাগা বলতে এটুকুই।
সাহেবদের দেশে এরকম ব্যতিক্রমী কল্পনার জগৎ নিয়ে বহু লেখা হয়, যার প্রচুর কাল্ট ফলোয়িং হয়। আমাদের দেশে বড়রা সেরকম রূপকথা পড়েন না। তবে কল্পনার জগৎ নিয়ে কল্পনা করতে তো অসুবিধে নেই! কিশোর বাবু কোন আশায় খেলাঘর বেঁধেছিলেন জানিনা, তবে রনিনের খেলাঘরের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট এবং তা ব্যতিক্রমী ও পরীক্ষামূলক বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিক নির্দেশ করছে ।
Tags
Indian