লেখকের নাম: সৌম্যসুন্দর মুখোপাধ্যায়
প্রকাশনী: অরণ্যমন
জঁর: অস্বস্তিকর গল্প/ডার্ক ফ্যান্টাসি
মূল্য: ৩০০ টাকা
ব্যক্তিগত রেটিং: ৬/১০
পরিত্যক্ত কাপড় কারখানায় ওঁত পেতে আছে অজানা আতঙ্ক। আলমারির ভেতরে লুকিয়ে থাকা অজানা জুজু একে একে কেড়ে নেয় নিরপরাধ শিশুদের প্রাণ। টেলিপোর্টেশনের সময় শরীরের ক্ষেত্রে সামান্য হলেও মনের ক্ষেত্রে তা হয়ে দাঁড়ায় অনন্তের শামিল। অজানা আগন্তুকের কাছে থাকে যেকোনো প্রশ্নের উত্তর। রাস্তার ধারের দোকান থেকে কেনা খেলনা দাঁতের পাটি পকেটে রাখলে সে যেন হঠাৎ জীবন্ত বস্তুর মত নড়েচড়ে ওঠে। গল্পগুলি পড়লে রীতিমত গায়ে কাঁটা দেয়। কিন্তু এদের প্রেক্ষাপট তথাকথিত "ভয়ের" গল্পের প্রেক্ষাপট নয়। আমাদের আশেপাশের চিরচেনা মানুষ, চিরচেনা ঘটনাগুলিই অবস্থার ফেরে এইরকম ভয়াবহতা এনে দেয়। সম্ভবত বাস্তবের সাথে এদের এত নৈকট্যই আমাদের ভয় পাইয়ে দেয়।
সসেমিরা : নাবিল মূহতাসিম Sosemira: Nabil Muhtasim
বারবার আমরা প্রশ্ন করতে থাকি, আমাদের সাথে এরকম হবে না তো? কবরখানা বা শ্মশানে নয়, এই অস্বস্তিকর গল্পগুলোর প্রেক্ষাপট আমাদের আশেপাশের চেনা পরিবেশ, যেখানে ঝকঝকে আলোর তলায় ওঁত পেতে থাকে ভয়, অচেনা মোড় থেকে হঠাৎ করে লাফিয়ে পড়ে আমাদের উপর। আমাদের অসহায় করে তোলে। এইরকমই তেরোটি "অস্বস্তিকর" গল্প আছে সৌম্যসুন্দর মুখোপাধ্যায়ের "দুঃস্বপ্নের দেবতা" গল্পসংকলনে। নামটি পড়লেই মনে পড়ে একইরকম অস্বস্তিকর আরেকটি গল্পসংকলনের কথা, স্টিফেন কিং এর "নাইটমেয়ারস অ্যান্ড ড্রিমস্কেপস"। লেখার একেবারে শুরুতে মাত্র কয়েক শব্দে যে কয়েকটি অস্বস্তিকর গল্পের সারমর্ম বলা হয়েছে, তার সবকটিই স্টিফেন কিং এর লেখা। এইরকম গল্পের ক্ষেত্রে স্টিফেন কিং সর্বকালীন শ্রেষ্ঠদের একজন, তাই এই সংকলনটি থেকেও প্রত্যাশা ছিল।
রুদ্রচণ্ডীমঠের ভৈরব - সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় Rudrachandimather Bhairab - Soumya Banerjee
সংকলনটি পড়তে মোটের উপর খারাপ লাগে না। কিছু গল্পের প্লট বেশ ভালো। এখানে যেমন রয়েছে শিশুকর্দম বা গন্ধপুকুরের মত ধ্রুপদী ভৌতিক গল্প, তেমনই রয়েছে ড্যাডি বা জ্যোৎস্নাবনের মত অতিপ্রাকৃত গল্প। ড্যাডি গল্পটিকে হয়তো বডি হরর গোত্রেও ফেলা যায়। এছাড়া রয়েছে টিকটিকি, মাম্মামের বাড়ি, খোলা দরজা, সূর্যমুখীর মত অস্বস্তিকর গল্প, যেখানে গল্পের সমান্তরালে চলতে থাকে অস্বস্তির এক চাপা স্রোত, যা গল্পগুলোকে শেষ অবধি পড়তে বাধ্য করে। সন্ধিপদী গল্পটিতে একটু তলিয়ে ভাবলে এক্সট্রা ডিমেনশনাল বা অতিমাত্রিক হররেরও ছোঁয়া পাওয়া যায়।
লাস্ট ট্রাম - বিশ্বদীপ দে Last Tram - Biswadip Dey
এদের থেকে আবার বেশ কিছুটা আলাদা মিনি, বুনো গোলাপ বা স্বপ্নপুরীর মত গল্প, যেখানে আবারও চেনা পরিবেশে আমরা এক অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠি, আমরা নিজেদের প্রশ্ন করতে থাকি, আমাদের সাথে এমন হলে আমরা কী করবো? সব মিলিয়ে বৈচিত্র্য দেখতে গেলে সংকলনটি বেশ ভালো, পড়ে সময় নষ্ট হল, এমন মনে হয় না। কিন্তু লেখক অনেক জায়গাতেই অস্বস্তি বা তথাকথিত "ভয়" আমদানি করতে গিয়ে একটু বেশিই বর্ণনা দিয়ে ফেলেছেন।
কৃষ্ণবেণী - সায়ন্তনী পূততুন্ড Krishnabani : Sainthani Preamtunda
আমার ব্যক্তিগত মত, এইরকম অস্বস্তিকর গল্পের ক্ষেত্রে পাঠক যদি অস্বস্তিটা নিজে অনুভব করেন, সেক্ষেত্রে গল্পের রস যেমন অক্ষুণ্ণ থাকে, পাঠকেরও সেই অস্বস্তির রসে জারিয়ে গল্পের কাছে একাধিকবার ফিরে আসার প্রয়োজন পড়ে। স্টিফেন কিং এর গল্পগুলো এই কারণেই বারবার পড়া যায়। এই বইয়ের সবকটি গল্পের কাছে হয়তো আমি ফিরে আসবো না। এর মধ্যে ব্যতিক্রম মিনি, খোলা দরজা, মাম্মামের বাড়ি, স্বপ্নপুরী। এই গল্পগুলো একাধিকবার পড়া যায় বলে মনে হয়েছে। লেখক বর্ণনার ক্ষেত্রে বা ভাষার ক্ষেত্রে একটু সংযত, একটু নৈর্ব্যক্তিক, একটু নিঃস্পৃহ হলে এই আতঙ্কের মাত্রা তাতে বহুগুণে বাড়তো। স্টিফেন কিং এর লেখার আমি একজন ভক্ত, আমার ধারণা তার অন্যতম কারণ তার লেখার এক নিরাসক্ত নির্লিপ্তি। সেটা লেখকের আগামী লেখায় আশা করবো।
স্বজনসকাশে - নবনীতা দেবসেন Shojonsokashe by Nabaneeta Dev Sen
বইটির প্রচ্ছদ শিল্পকর্ম হিসেবে আমার ভালো লেগেছে, এবং বইয়ের একটি গল্পের বিষয়বস্তুও তাতে ফুটে উঠেছে। কিন্তু গোটা বইয়ের লক্ষ্য যে অস্বস্তি নিয়ে আসা, সেটা প্রচ্ছদ দেখে বোঝা একটু কঠিন হতে পারে। আরেকটু সরাসরি প্রচ্ছদ, বা একটু মিনিমালিস্ট প্রচ্ছদ হলে আমার ভালো লাগতো। সবমিলিয়ে দুঃস্বপ্নের দেবতা পড়ে আমার ভালোই লেগেছে। সমকালীন বেশ কিছু বই পড়ে পরে মনে হয়েছে, সময়টা নষ্ট হল। বইটি সেই পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছে। এই লেখকের অন্যান্য বইয়ের দিকে নজর রাখবো।
পূরণজিতের রত্নভাণ্ডার - দীপান্বিতা রায় Puranjiter Ratnavandar by Dipanwita Roy
পুনশ্চঃ সৈকত মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকাটি এই বইটির সম্পদ। অযথা অবান্তর ব্যক্তিগত আলাপচারিতা বা বৈষ্ণববিনয় না করে একটি প্রায় অ্যাকাডেমিক আলোচনা সেখানে পাওয়া যাবে। এই রসে আগ্রহীদের সেটি আরও নানা মণিমুক্তো খুঁজে পেতে সাহায্যই করবে।